প্রজাপতি হবে ব’লে এক ঘোটকীর কান্না
অনুবাদ : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রজাপতি হবে ব’লে এক ঘোটকীর কান্না
১.
ক্রমাগত জলের ওপর, দিক্চক্রবাল,
নদী ভাগ
চিরে যাওয়া অক্সাস নদী
কিছু একটা দাঁড় করাচ্ছে কেউ
অথবা
বালির ওপরে কোনো হিন্দু মন্ত্র
ঘুরছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে, রাস্তায় এবং শব্দের পাদদেশে
প্রত্যেকবার কথা হয়ে উঠতে গিয়ে, সংযুক্ত হতে গিয়ে অথবা হয়তো বিসংযুক্ত হতে
ভেজা কালির দোয়াত
কুঁচকে যাচ্ছে কাচের বোতলের ভেতর
এই সংযুক্তি শুধু নিজেকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য
নিঃশ্বাসের কুণ্ডলী ছুঁয়ে ফেলছে মাটির কাপের এই দেওয়াল
পাঁচটা ইন্দ্রিয় থ্রি-ডাইমেনশনাল হয়ে যাচ্ছে
কোঁকড়ানো, না-কোঁকড়ানো, ঠোঁটের মোমের উত্তেজনায়
এলোমেলো ভাবে রাস্তায় ঘুরছে একটা লোক, ক্যান্সার নিয়ে
নিঃশ্বাসের প্রচণ্ড খ্যাপামি থিতু হয়ে আছে চায়ের কাপে
বড়ো বড়ো চোখ ক’রে একদৃষ্টে একটা তাকিয়ে থাকা দড়ি দিয়ে বাঁধছে একে অপরকে
চাইনিজ সুগন্ধের মিষ্টি মনমরা গন্ধ ;
আমাদের শরীরের একটা অংশ চলে যাচ্ছে তিব্বতের দিকে
প্রজাপতি হবে ব’লে সে এক ঘোটকীর কান্না
২.
বীয়ারের ক্যান আর বেশ কিছু ডলার
মেয়েটিকে দেখছে লোকটা, নিচ থেকে ওপরে
তার ভূমধ্যসাগরীয় দৃষ্টিতে
বড়ো গর্বে, তুলে নিচ্ছে ক্যানাবির পাতা
শব্দের আগুনে পোড়াচ্ছে সেই দৃষ্টি
তেসরা অগাস্ট, নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে সে
এক মায়া, বিভ্রমের দিকে থিতু হতে, দূরে
সুসভ্যতার ওপারে
৩.
একজন বলেছিল মুক্তির পেয়ালায় মদ খাওয়ার কথা
একজন দৌড়েছে আর দৌড়েছে একা ইলেক্ট্রনের করিডরে
একজন রাস্তায় ঢুকেছিল
একজন পৌঁছে গেছিল ব্রিজের কাছে, নিজ থেকে নিজের হয়ে উঠছিল একজন
ঠোঁটের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর এবং হাস্য
এখনও ওখানেই আছো?
সেই জায়গাটা, যেখানে পথ আদতে পথ, আর পথিক উঠে এসেছে রাস্তার ওপরে
উড়তে থাকা বালি তীক্ষ্ণ হচ্ছে বালিয়াড়ি হওয়ার জন্য, ঘুরেই চলেছে
আর তোমাকে এনে ফেলছে
নিমরুজ মরুতে
যেখানে উপস্থিত এক মালয়ালি ;
অদ্ভুত এই জিওমেট্রিক কম্পোজিশনটা ভাবো একবার
ভাইরাস রাইটিং
১.
ভাইরাস লিখছি
লিখছি ইলেক্ট্রনিক গোলকধাঁধা
এই অন্ধকারে ব’সে,
মাসে সাত হাজার টাকার ভাড়া বাড়িতে
এটা কাবুল, আফঘান রাজধানী
আশ্চর্য, কিরকম ফালতু কবিতা হচ্ছে এটা?
এবারে নিজেকে জিগ্যেস করো, কবিতাও কি সেই একই নিঃসঙ্গ অক্ষরমালা
বিদ্যুতের দরদালানে ভবঘুরের মতো ঘুরছে
অস্তিত্বের গোড়া থেকে কাটো
ছোঁড়ো
আর উপায়ান্তর নেই, কবিতাটা হয়ে ওঠা ছাড়া
রাস্তার মধ্যে, রাস্তার ওপরে কবির কল্পনা ঘুরছে তুমি দেখতে পাচ্ছো
আরেকটা শব্দের দিকে শেকল ছুঁড়ছো
এই বুনো ও বন্যকে বশ করার চেষ্টা।
না পারলে,
তোমার খেল্ খতম
একটা কম্পিউটার যেভাবে ক্র্যাশ করে
৩.
তুমি, আর তুমি, হ্যাঁ তুমিও
তুমি, আর তুমি
তোমাদের সবাইকে এ্যারেস্ট করা হ’ল
৪.
লেখালিখি বন্ধ করো। এরকমই বলা হ’ল আমায়।
লিখলে, ঘরের মধ্যে গুয়ান্তেনামো দেখিয়ে দেবো
লিখলে, মরতে হবে।
কাবুল, ’০৭-এর গ্রীষ্ম
হাতে হাতকড়ি, পায়ে শেকল
এটা আফঘানিস্তান, এটাই চলছে
ডেড বডির ওপর ডেড বডি
লেখা বন্ধ করা ছাড়া কবিতার আর কোন রাস্তা আছে কি?
এটা জেলখানা।
৫.
কাবুলের চড়ুই পাখিটাকে জিগ্যেস করা হ’ল
এই মানবজাতির শেষ পর্যন্ত কি দশা হবে হে?
চড়ুইটা ভাবলো, বেশ মন দিয়েই ভেবে দেখলো
আর পুটুস ক’রে মরে গেল
—————————————————————–
আফঘানিস্তানের দারি ও হাজারাগি ভাষার কবি, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী কামরান মীর হাজার। জন্ম ১৯৭৬-এ। দারি [Dari] এবং হাজারাগি [Hazaragi]হ’ল মূলত ফারসি ডায়লেক্ট। মীর হাজার তাঁর স্ত্রী ও চার বছরের কন্যা সন্তানকে নিয়ে বর্তমানে নরওয়েতে থাকেন। প্রকাশিত কবিতার বই— ‘কেতাব-এ-মেহ্র্’ ; ‘দ্য ক্রাই অফ এ মেয়ার্ এ্যাবাউট টু বিকাম এ বাটারফ্লাই’। হাজারের কবিতায় ওঁর ফারসি ভাষা-সংস্কৃতি ঐতিহ্যের প্রভাবের সাথে লাতিন আমেরিকান লেখকদের প্রভাবও লক্ষণীয়। চারবছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ডাচ ভাষায় অনূদিত ওঁর কবিতার সঙ্কলন। ২০১২-তে প্রকাশিত এস্পানিওলে অনূদিত ওঁর কবিতার বই ‘Chorro De Ciervos’। ২০০৪ থেকে নিউজ ওয়েবসাইট ‘কাবুলপ্রেস’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। এরপর খুব তাড়াতাড়ি আফঘানিস্তানের সর্বাধিক পঠিত নিউজ ওয়েবসাইট হয়ে ওঠে এটি। আফঘান সরকারের অর্থনৈতিক দুর্নীতি এবং সে দেশে উন্নয়নমূলক কাজে নিয়োজিত এন-জি-ও গুলির লক্ষাধিক ডলার তছরুপের খবর প্রকাশ করে দিচ্ছিল এই কাবুল প্রেস। কয়েক সপ্তাহ বাদেই এই ওয়েবসাইটকে ব্যান ক’রে দেওয়া হয় আফঘানিস্তান এবং ইরানে। দু’-দু’বার আটক করেছে ওঁকে আফঘান প্রশাসন। কাবুলে দুটি ন্যাশনাল রেডিও স্টেশনে নিউজ এডিটর হিসেবেও কাজ করেছেন। হামিদ কারজাই-এর স্বৈরাচারী এবং দমনমূলক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ওঁর লড়াইকে সমর্থন করেছে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ জার্নালিস্টস্ [IFJ] এবং কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস্ [CPJ]। তেইশ বছর বয়েসে, ১৯৯৯-এ আফঘানিস্তানের মানুষের প্রকৃত অবস্থার কথা জানিয়ে ইউনাইটেড নেশন, ইউনেস্কো এবং ইউনিসেফকে খোলা চিঠি লেখেন মীর। ৩৩০ জন আফঘান এবং ইরানীয় বুদ্ধিজীবীর সই সম্বলিত সে চিঠি। কবিতার পাশাপাশি রাজনৈতিক বিষয় এবং সেন্সরশিপ নিয়েও নিয়মিত লেখেন মীর হাজার। নরওয়ে থেকে দারি ভাষায় লেখা ওঁর বই ‘সেন্সরশিপ ইন আফঘানিস্তান’ প্রকাশিত হয়েছে বছর কয়েক আগে। আফঘানিস্তানে বাক্ স্বাধীনতার অধিকার দমন নিয়ে লেখা এটাই প্রথম বই। আফঘান শাসক কর্তৃপক্ষের শতাধিক বছরের ছবি এ’ বইতে তুলে এনেছেন মীর। আফঘানিস্তানের নতুন প্রজন্মের সাহিত্য নিয়েও ওঁর একটি বই আছে। ‘রিডিং এ্যাণ্ড রাইটিং’। ২০১৪-তে প্রকাশিত হয়েছে মীরের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ সঙ্কলন ‘স্ট্রীম অফ ডীয়ার’ [Stream of Deer]।